আমি মোঃ রাকিবুল হাসান, ফাইভারে একজন টপ রেটেড সেলার হিসেবে কর্মরত। গত দশ বছর ধরে আমি আর্কিটেকচার এবং থ্রিডি ভিজ্যুয়াল ক্যাটাগরিতে কাজ করছি এবং ফাইবার মার্কেটপ্লেসে আমার কাজের অভিজ্ঞতা সাত বছরের। এই সময়ে আমি ৬০০টিরও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। আজ আমি আপনাদের সাথে আমার ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শেয়ার করব।
২০১২ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হওয়ার সময় ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না, তবে ছোটখাটো কিছু প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর আমি প্রথমে একটি চাকরিতে যোগদান করি। সেই সূত্রে ২০১৪ সালে আমি মালয়েশিয়ায় যাই এবং সেখানে চার বছর মাল্টিন্যাশনাল প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ পাই। এই প্রজেক্টগুলোতে কাজ করার সময় আমি আর্কিটেকচার এবং থ্রিডি ভিজ্যুয়াল সম্পর্কে জানতে পারি এবং এই কাজের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। মালয়েশিয়ায় আমার বেতন ভালো থাকায় তখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি তেমন মনোযোগ দেইনি।
কিন্তু ২০১৮ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। দেশে ফিরে আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে সহজেই একটি ভালো চাকরি খুঁজে নিতে পারব। তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়লাম। চারপাশে বন্ধু-বান্ধব থাকলেও, আশানুরূপ কিছুই ঘটছিল না। অবশেষে চার মাস বেকার থাকার পর আমি এলজিইডিতে একটি প্রকল্পে চাকরি পাই। তবে এই চার মাস আমি বসে ছিলাম না; চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সত্যি বলতে, তেমন কোনো কার্যকরী দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত, ২০১৮ সালে আমি ফাইভারে একটি অ্যাকাউন্ট খুলি।
অ্যাকাউন্ট খোলার সাথে সাথেই আমি কোনো গিগ তৈরি করিনি। প্রথমে আমি আমার ক্যাটাগরির টপ রেটেড এবং লেভেল ২ সেলারদের প্রোফাইলগুলো মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করি। তাদের গিগ ডেসক্রিপশন, প্রোফাইল, ইমেজ এবং অন্যান্য সবকিছু দেখার চেষ্টা করতাম। আমার মনে হয়েছিল, একজন নতুন সেলার হিসেবে মার্কেটপ্লেসে টিকে থাকতে হলে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে হবে। নিজের প্রোফাইল এবং গিগ এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে কোনো বায়ার যখন আমার প্রোফাইল দেখে, তখন তা অন্যদের থেকে কিছুটা ভিন্ন মনে হয়। এই ভাবনাগুলো মাথায় রেখেই আমি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমার প্রথম গিগ সাবমিট করি।
এরপর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আমি ফাইভারে আমার প্রথম অর্ডার পাই, যা ছিল ৫০ ডলারের। সেই শুরু, এরপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৯ সালের মধ্যেই আমি লেভেল ওয়ান সেলারের মর্যাদা লাভ করি। তবে লেভেল ওয়ান হওয়ার পর আমার অর্ডারের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। আমি নতুন করে ফাইভার গিগ নিয়ে অনলাইনে পড়াশোনা শুরু করি এবং একইসাথে অন্যান্য টপ রেটেড সেলারদের প্রোফাইল দেখতে থাকি। আমি বুঝতে পারলাম, লেভেল আপ হওয়ার সাথে সাথে নিজের দক্ষতা, যোগাযোগ এবং কাজের গুণগত মান – এই সবকিছুতেই উন্নতি করতে হবে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে আমি নিয়মিতভাবে আমার প্রোফাইল এবং গিগ আপডেট করতে থাকি। এর ফলস্বরূপ, আমি অনেক ভালো ভালো প্রজেক্ট পেতে শুরু করি, যেগুলোর বাজেটও বেশ ভালো ছিল। সেই সময় টপ রেটেড সেলার হওয়ার জন্য ২০ হাজার ডলার আয় করার পাশাপাশি ১০০টি অর্ডার সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। আমি ২০২০ সালে প্রথম শর্তটি পূরণ করলেও, অর্ডারের সংখ্যা কম থাকায় টপ রেটেড হতে পারিনি। যাই হোক, ২০২১ সালের মার্চের মধ্যেই আমি সমস্ত প্রয়োজনীয়তা পূরণ করি এবং অবশেষে ২০২১ সালের অক্টোবরে আমি ফাইভারে টপ রেটেড সেলারের স্বীকৃতি লাভ করি।
এই পুরো সময়টা, অর্থাৎ ২০১৮ সালে চাকরি পাওয়ার পর থেকে, আমি চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে গেছি। আমার চাকরিটি ছিল একটি সরকারি প্রকল্পের অধীনে, যেখানে ঢোকার সময় নির্দিষ্ট থাকলেও বের হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। এর মধ্যেই আমি আমার ফ্রিল্যান্সিং কাজও সামলে নিয়েছি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমি আমার চাকরি ছেড়ে দেই এবং পূর্ণtime ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। আল্লাহর রহমতে, ফ্রিল্যান্সিং থেকে আমার যা আয় হচ্ছে, তা আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট।
আমার এই ফ্রিল্যান্সিং যাত্রায় আমার স্ত্রী সবসময় আমাকে সমর্থন জুগিয়েছে। তার সহযোগিতা ছাড়া এতদূর আসা সত্যিই কঠিন ছিল। আমাদের সমাজে ফ্রিল্যান্সিংকে এখনো ভালোভাবে দেখা হয় না। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও ফ্রিল্যান্সিং করার সিদ্ধান্ত অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। পরিবার, বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে যখন আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা বলি, তখন অনেকেই আমাকে চাকরি করার পরামর্শ দিত। কিন্তু আমি সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করার চেষ্টা করেছি এবং অনেক সময় অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমার মনে আছে, ২০১৯ সালে যখন আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি, তখন আমার প্রথম সন্তানের বয়স ছয়-সাত মাস ছিল। সারাদিন চাকরি করে আসার পর আমার মেয়ে সবসময় আমার কাছে থাকতে চাইত। তাকে কোলে নিয়েই আমি বসে বসে কাজ করতাম এবং ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলতাম।
আমি যে ক্যাটাগরিতে কাজ করতাম, তার জন্য অনেক সময় ভালো কম্পিউটারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শুরুতে আমার কাছে তেমন ভালো কিছু ছিল না। এ কারণে আমাকে বেশ কিছু ভালো প্রজেক্ট ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর সময়টা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল, কারণ একদিকে হোম অফিস এবং অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ – দুটো মিলিয়ে আমাকে প্রচুর সক্রিয় থাকতে হতো। এই পুরো কোভিডকালে ফাইভারে আমার উপার্জনের মাধ্যমেই আমি এবং আমার পরিবার টিকে ছিলাম, কারণ আমার অফিসের বেতন আটকে গিয়েছিল।
সংক্ষেপে এটাই ছিল আমার ফ্রিল্যান্সিংয়ের পথচলা। আপনাদের কাছে এই যাত্রা খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে অনেক অজানা গল্প, অনেক কষ্টের মুহূর্ত এবং অনেক নির্ঘুম রাত লুকিয়ে আছে।
এতক্ষণ তো নিজের কথাই বললাম। এবার কিছু মূল্যবান কথা বলি, যা আপনাদের উপকারে আসতে পারে। এই কথাগুলো আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি:
কখনও হাল ছেড়ে দেবেন না. জীবনে অনেক বাধা আসবে, কিন্তু কখনোই আশা হারানো উচিত না।
নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন এবং নিজের কাজের প্রতি আস্থা রাখুন. আত্মবিশ্বাস সাফল্যের চাবিকাঠি।
ফ্রিল্যান্সিং করতে হলে প্রচুর মনোযোগ এবং অধ্যাবসায় থাকতে হবে. ইন্টারনেটের এই যুগে ভালোভাবে পড়াশোনা করুন, গবেষণা করুন। বিশ্বাস করুন, প্রয়োজনীয় ৯০% রিসোর্স এখানেই বিদ্যমান।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, আমার কোনো মেন্টর ছিল না। এতদূর আসার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমার কাজের প্রতি আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা। অন্যকে দেখে পেশা নির্বাচন করবেন না; যে কাজটি আপনার ভালো লাগে, সেটাই করুন।
Inspired by Rakibul's journey? Visit his Fiverr profile to explore his work and see how he does it.